রহিম আব্দুর রহিম

১৯৯৪ এর কথা। দক্ষিণ জামালপুরের লীড প্রতিষ্ঠান দিকপাইত ধরনীকান্ত মহুমুখী উচ্চ বিদ্যালয়ের ভলান্টিয়ার শিক্ষক হিসেবে কয়েকদিন ক্লাস নিয়েছি। পড়িয়েছি বাংলা। ওই সময়ের অষ্টম শ্রেণির ছাত্র মুনসুর আলী খুবই চটপটে স্বভাবের মেধাবী ছাত্র ছিল। বর্তমানে সে জামালপুর জেলার সরিষাবাড়ি উপজেলার রঘুনাথপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারি শিক্ষক। স্মার্ট, দক্ষ, প্রতিভাবান এই শিক্ষক শিশু-কিশোরদের নিয়ে সময় কাটায়। তাদের সুখ-দুঃখ নিয়ে ভাবে, মুনসুরকে ধন্যবাদ। ওদের গ্রামে থেকেই হাইস্কুল জীবন কাটিয়েছি। লেখাপড়া করেছি দিকপাইত ধরনীকান্ত বহুমুখী উচ্চ বিদ্যালয়ে। ৮০’র দশকের প্রানান্ত ও জীবন্ত শৈশব। স্কুলের মঞ্চ নাটক, গ্রামের পালাগান, মেলা পার্বনের আনন্দঘন পরিবেশের মধ্য দিয়ে বড় হয়েছি। মুনসুর আলীর গ্রামের বাড়ি, করবাড়ি-কদুলায় অনেকদিনপর যাবার ইচ্ছা হয়েছিল। সে আমার ইচ্ছা পূরণ করেছে। বাড়ি যাওয়ার পর তার বাইকে ঘুরে বেরিয়েছি শৈশব এলাকার প্রিয় প্রকৃতিতে। প্রিয় ছাত্র মুনসুরকে নিয়ে আবারও কথা হবে। এই লেখার কোন এক পর্যায়ে। এবার চৌদ্দ বছর বয়ষ্ক শিশু শিক্ষার্থী (যার নাম গোপন রাখা হল)। তাকে নিয়ে আমার একটি বাস্তব অভিজ্ঞতা তুলে ধরছি। এই শিশু শিক্ষার্থী গত এক মাস আগে আমার মাদ্রাসায় অষ্টম শ্রেণিতে ভর্তি হয়েছে। এই ছেলে, বাবা-মার একমাত্র পুত্র সন্তান। অতি আদর, পিতা-মাতার দেখ-ভালের ত্রুটির ফলে সে এই বয়সে তাস, জুয়া, বিড়ি, সিগারেট টানাসহ বয়সের দোষে পড়েছে। সে স্কুলেও যায় না, তাকে একটি স্কুল থেকে বের করে দেওয়া হয়েছে। ওর লেখাপড়ার আগ্রহ প্রচন্ড। আমার প্রতিষ্ঠানের শিশু নাট্যকর্মীদের হাত ধরেই ও এসেছে আমার কাছে, মাদ্রাসায় ভর্তির আবেদন নিয়ে। মাত্র দেড়’শ টাকার বিনিময়ে ওকে ভর্তি করে নিয়েছি। একমাসের মধ্যে ওর বয়সের দোষ ৮০% কমে এসেছে। বাকি টুকু জীবনের ব্যালেন্সের জন্যই প্রয়োজন রয়েছে। পাঠকরা মনে করছেন, লেখাটিতে এ শিশু ছাত্রের গল্পের কি প্রয়োজন ছিল? অবশ্যই প্রয়োজন আছে। স্কুল থেকে মাদ্রাসায় ভর্তি। সরকারি সাপ্লাই না থাকায়, শ্রেণির এখনো দু’একটি বই দেওয়া সম্ভব হয় নি। এরপর সাধারণ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে, মাদ্রাসায় আসায় নতুন আরো একটি ভাষা (আরবী), তাকে রপ্ত করতে হচ্ছে, এ কারনেই এই ছেলে শিক্ষার সহজ পদ্ধতি অবলম্বন করে, গাইড কেনার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। নয়শত টাকা মূল্যের গাইড কিনার বিষয়টি মধ্যবিত্ত বাবাকে জানিয়েছে। তার বাবা নাকি তাকে বলেছে, ‘সরকার কিসের বই দেছে, আরহ কিনিবা লাগেছে, তাহ আরহ্ একখান বইয়ত এতলা টাকা? এইলা কাথা মাইনসে কহচে তুমার সরকারের বদনাম হচে।’ কথাগুলো এই শিক্ষার্থী আমাকে ফোনে জানিয়েছে। তার কথাশুনে ওকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, এখন উপায়, ও উত্তরে বলেছে, ‘হামার বইখান তুমাক কিনে দিবা লাগিবে।’ তার কথা অনুযায়ী তাকে শহরে গিয়ে ওই বই বিক্রেতাকে ফোনে ধরিয়ে দিতে বলেছি। সে তাই করেছে। বিক্রেতার সাথে আমি কথা বলেছি। গাইডটির দাম নয়শত টাকা। শুধুমাত্র আমার জন্য পঞ্চাশ টাকা কমিশন দেবে, এরূপ কথাই বিক্রেতা বলেছেন। আমার প্রশ্ন, সরকার সহজলভ্য শিক্ষা ব্যবস্থা চালুতে নিরন্তর শ্রম, অর্থ, মেধা-মনন দিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু নোট-গাইড, প্রাইভেট-কোচিং কেন বন্ধ করতে পারছে না, বুঝে উঠতে পারছি না। মনে হয় বিক্রেতা আমাকে যেমন পঞ্চাশ টাকা কমিশন দিতে চেয়েছেন, তেমনি সংশ্লিষ্ট মহলের দায়িত্বশীলরা কোন কমিশন নিয়েছে কিনা আমার সন্দেহ হচ্ছে। এবার প্রায় এক বছর পর গ্রামের বাড়ি যাওয়া, গ্রামের মা-বোনরা তাদের সুখ দুঃখের নানা কথা শোনালেন। নানাবিধ সমস্যার মধ্যে একটি মাত্র সমস্যা উপস্থাপন করছি।

এলাকায় সন্ধ্যা নামলেই গাঁজা, ভাংসহ নানা জাতের নেশারাজ্যে ডুবে যায় এলাকার যুবক তরুনরা। এক মা তার সন্তানকে নেশার হাত থেকে দূরে রাখতে লেখাপড়া বন্ধ করে, তাবলীগ জামাতে পাঠিয়েছিলেন। চল্লিশ দিনের চিল্লা শেষ করে বাড়ি ফিরেছে, কিন্তু নেশা ছাড়েনি। আরও বেড়েছে। উপায়ন্তর না পেয়ে, ছেলেকে বিয়ে দিয়েছে। গার্মেন্ট্ ফ্যাক্টরীতে কাজ করে, থাকে ঢাকায়, সেখানেও নেশা করে। ঘুম থেকে উঠে ১২ টায়, চাকরি নেই। এখন ছেলের বউকে টাকা পাঠাতে হয়, এ যেন বাবা-মা’র গলায় এক ফাঁসির দঁড়ি। এর উপায় জানতেই আমার কাছে। সময়ের এক ফোঁড়, অসময়ের দশ ফোঁড়, উপায় নেই। বুদ্ধি সোজা সাপ্টা। পুলিশে দেন। কয়েকদিন জেল হাজতে থাকুক। রাজি হলেন, পরের দিন থানা পুলিশে দেওয়া হবে। রাত পোহালেই সব শেষ, মায়ের মন, তা কি আর হয় ? এলাকায় কোন অভাব নেই। একজন দিনমজুরের মজুরী নগদ সাড়ে ছয়’শ টাকা, তিনবেলা খাবার, সব মিলিয়ে একজন শ্রমিকের দৈনিক ভাতা আটশ টাকা। এর পরও শ্রমিকের প্রচন্ড অভাব। কর্মব্যস্ত এলাকায় নেশার ভাগাড়ের পরিবেশ অত্যন্ত দুঃখজনক, বিপদজনক। এর উপর খাদ্যজাত দ্রব্যের দাম বেড়েই চলছে, বিদ্যুতের ভেলকিবাজিও কম না। সব মিলিয়ে সরকারকে কোন বেকায়দায় ফেলার কৌশল নিয়ে কোন মহল মাঠে নেমেছে কিনা? এ ধরনের সন্দেহ অনেকেই করছে। এলাকার অবস্থা বর্ননা করে পাঠককে কষ্ট দিতে চাইনা। মূল আলোচনায় যাচ্ছি।

গত ১৮ মে জাতীয় শিশু পুরষ্কার প্রতিযোগিতার পুরষ্কার বিতরণ অনুষ্ঠানে রাষ্ট্রপতি মো. আব্দুল হামিদ বলেছেন, ‘আজকাল শিশুদের লেখাপড়া নিয়ে জীবনের শুরুতেই চরম প্রতিযোগিতা শুরু হয়। এই প্রতিযোগিতায় শিশুদের চেয়ে, তাদের মা-বাবা ও অভিভাবকদের আগ্রহই বেশি দেখা যায়। শিশুদের ধারণ ক্ষমতা চিন্তা না করেই কয়েকজন টিউটরের কাছে পড়ছে বা কে কত বেশি নম্বর পেল সেটাই প্রাধান্য দেওয়া হয়। এতে শিশুদের স্বাভাবিক বেড়ে ওঠা বাধাগ্রস্ত হয়।’ শিশুদের স্বাভাবিক বিকাশে বাধা না দেওয়ার আহবান জানিয়ে রাষ্ট্রপতি বলেন, ‘ফুলকে যেমন পরিপূর্ণভাবে ফুটতে দিলে তা চারদিকে সুগন্ধ ছড়ায়, তেমনি শিশুদের তাদের মত করে বড় হওয়ার সুযোগ দিলে তারা সমাজের জন্য কল্যাণ বয়ে আনতে পারে। এর জন্য দরকার, শিশুদের জন্য সব ধরনের সহযোগিতা নিশ্চিত করা। শিশুকে শিশুর মতই থাকতে দিতে হবে। শিশুর ব্যক্তিত্ব, আগ্রহের প্রতি আস্থা রাখতে হবে। অহেতুক বা ইচ্ছার বিরুদ্ধে শিশুদের কিছু চাপিয়ে দিলে; শিশুদের স্বাভাবিক বিকাশ বিঘিœত হতে পারে। তাদের স্বপ্ন ভেঙ্গে যেতে পারে।’ এই অনুষ্ঠানেই তিনি শিশুদের উদ্দেশ্যে বলেছেন, এখন থেকেই সত্যকে সত্য, আর মিথ্যাকে মিথ্যা বলতে চর্চা করবে। ন্যায়-অন্যায়, ভালো-মন্দের পার্থক্য বুঝতে শিখবে।’ উপরে উল্লেখিত রাষ্ট্রপতির বক্তব্য বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় ও অনলাইন নিউজ পোর্টালের বিভিন্ন শিরোনামে প্রকাশ হয়েছে। রাষ্ট্রপতি মো. আব্দুল হামিদ শুধু রাষ্ট্রপতি নয়, তিনি সত্যিকার অর্থেই একজন আদর্শ পিতা, অভিভাবক, শিক্ষক, এতে কোন সন্দেহ নাই। শিশুদের মনোবিশ্লেষণ ও শিশু বিকাশের উপর বেশ কয়েকটি প্রশিক্ষণে অংশ নিয়েছি। যে সমস্ত কথা প্রশিক্ষণ থেকে জেনেছি, হুবহু সে কথাগুলোই মহামান্য রাষ্ট্রপতি বলেছেন। শিশুর মনের কথা, বাস্তব চিত্র অনুধাবন করেই তিনি এই জ্ঞানগর্ভ বক্তব্য রেখেছেন। আমার প্রশ্ন , তাঁর এই বক্তব্য শিশুরা শুনে কি করবে? শিশুর অভিভাবক, শিশুর শিক্ষক, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, শিক্ষা পরিচালনা পর্ষদ, যদি শিশুবান্ধব, শিক্ষা বান্ধব না হয়, তবে আদর্শ মানব সম্পদ তৈরি করা আদৌ সম্ভব নয়। আজকের এই শিশুরা রাষ্ট্রপতির বক্তব্যে চলমান জীবনে কোনভাবেই কাজে লাগাতে পারবে না। কারণ ইস্পাতের দেয়ালে তাদের স্বাধীনতা আবদ্ধ। তবে কোন এক সময় আদর্শ পিতা-মাতা হওয়ার ক্ষেত্রে কাজে লাগবে, যদি স্মৃতিপটে তা ধরে রাখতে পারে। মহামান্য রাষ্ট্রপতি শিশুদের সৎ মানুষ হওয়ার এবং ন্যায় অন্যায় ও ভালোমন্দের পার্থক্য বুঝতে শেখার পরামর্শ দিয়েছেন। সৎ, ন্যায় পরায়ন হতে হলে এবং ভাল-মন্দের পার্থক্য বুঝতে হলে ওই শিশুটির স্বাধীনভাবে চলার, বলার, খেলার সুযোগ করে দিতে হবে, শিশুর যৌক্তিক মতামত গ্রহণ করতে হবে। ইতিবাচক সকল কর্মকান্ডে অনুপ্রাণিত ও উৎসাহিত করতে হবে। এটাই শিশু গবেষকদের গবেষণালব্ধ নির্দেশনা। কিন্তু তা কি বাস্তব জীবনে প্রতিফলিত হচ্ছে? যে শিশুটি শিক্ষা নামের নরক যন্ত্রনার চরম শৃঙ্খলে বন্দি, সেই শিশুটি কিভাবে আমার মহামান্য রাষ্ট্রপতির স্বপ্নসাধ পূরণ করবে, এটাই এখন ভাবতে হবে, দেখতে হবে এবং বাস্তবায়ন করার আনুষ্ঠানিক উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে।

গত ১৯ মে একটি অনলাইন নিউজ পোর্টালে এবং ২০ মে দৈনিক সংবাদ পত্রিকায় ড. জাফর ইকবালের, ‘এই লেখাটি অভিভাকদের জন্য’ শিরোনামের লেখাটি আমি খতিয়ে-নতিয়ে পড়েছি। লেখক, গত এসএসসি পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশ হওয়ার ১০ দিন আগে একটি চিঠি পেয়েছিলেন, যে চিঠিটি তিনি হুবহু পত্রিকায় প্রকাশ করেছেন। তাঁর মতামত, যুক্তি এবং বিজ্ঞান প্রয়োগ করে বক্তব্য তুলে ধরেছেন। চিঠিটির সারাংশ এই রকম, ১৬ বছরের কোন এক মেয়ে জেএসসিতে না পাওয়ায়, তার মা মরা কান্নার মত কেঁদেছে। তার বাবা এই মেয়ে কিছুই করতে পারবে না বলে লোক সমাজে প্রচার করেছে। এসএসসি পরীক্ষার ফলাফলে বাবা-মার স্বপ্ন পূরণ করতে না পারলে অর্থাৎ না পেলে, তার বেচে থাকাই অসম্ভব হয়ে পড়বে। এজন্য এই মেয়ে ঘুমের ১৩টা ট্যাবলেট জোগাড় করে ফেলেছে। সে বিজ্ঞান বোঝেনা, বাবা-মা তাকে ডাক্তার বানানোর স্বপ্ন দেখছে। আশ্চর্য ! স্বপ্ন সন্তানের, দেখে বাবা-মা, পত্রের আলোকে; বাস্তবতার নিরিখে ড. জাফর ইকবাল বলেছেন, ‘নতুন এক ধরনের অভিভাবক ‘প্রজাতি’র জন্ম হয়েছে। লেখাপড়া নিয়ে তাদের সম্পুর্ণ একধরনের চিন্তা ভাবনায় এই দেশের ছেলেমেয়েদের শৈশবকে পুরোপুরি ধ্বংস করে দিচ্ছে। যে কৈশোর বয়সে স্বপ্ন দেখবে, সেই বয়সে যদি একজনকে ঘুমের ট্যাবলেট মজুদ করতে হয়, তাহলে আমরা এই শিশু শিক্ষার্থীদের জীবনে কি স্বপ্ন দেখাতে শেখাব ? ড. জাফর ইকবালের এই প্রশ্নের উত্তরে বলতে হয়, শিক্ষার্থীদের সাথে সাথে অভিভাবকদের কোন ক্লাসের ব্যবস্থা করা যায় কিনা ? ড. জাফর ইকবালের ভাষায় ‘প্রজাতি’দের সভ্য, আদর্শ পিতা-মাতা করার জন্য সন্তানের পাশাপাশি তাদের জন্য সপ্তাহ, পাক্ষিক বা মাসিক কোন পরামর্শ ক্লাস করার ব্যবস্থা করা, অথবা সন্তানের পড়াশোনা এবং ফলাফল ড্রাবল অথবা ট্রিপল পাইতে মা-বাবাকেই পরীক্ষা দেওয়া বাধ্য করা যায় কিনা ? এতে করে বাবা-মার স্বপ্ন যেমন পূরণ হবে তেমনি এই সুযোগে কোমলমতি শিশু-কিশোররা তার শৈশব জীবনের পূর্ণাঙ্গ সাধ গ্রহণের সুযোগ পাবে। একই সাথে শিশুর স্বপ্ন শিশুই দেখবে এবং সৎ, পরীক্ষিত, ন্যায় পরায়ন মানুষ হওয়ার দীক্ষা গ্রহণ করবে। সবচেয়ে বড় উপকার হবে ড. জাফর ইকবালের চিঠির নায়ক ১৬ বছরের ঘুমের ট্যাবলেট মজুদকারী হাজারো নায়কদের।

সর্বোপরি লেখাটির শিরোনামের মুনসুর আলীর শিক্ষামন্ত্রীর অংশে আসছে। গত কয়েকদিন আগে আমার ছাত্র মুনসুর আলী, সে তার ফেইসবুক স্টাটাসে আমাদের শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ, শিক্ষা ব্যবস্থা এবং শিক্ষা পরিচালনা পদ্ধতির উপর ক্ষোভ ঝেড়ে লেখেছেন ‘মাননীয় মন্ত্রী পৃথিবীর সেরা শিক্ষা ব্যবস্থার তালিকায় রয়েছে ফিনল্যান্ড। যে দেশের স্কুলে প্রথম ৬ বছর পরীক্ষা হয় না। ১০ বছর পর পরীক্ষা হয়। অথচ বাংলাদেশে ফাস্টটার্ম, মিডটার্ম, বার্ষিক, পিইসি, জেএসসি, এসএসসির মত পরীক্ষা নামের স্ট্রিম রোলারে নিস্পেশিত কোমলমতি শিশু কিশোররা। জাপান এবং কোরিয়ার মত দেশে ম্যাথ এবং প্রোবলেম সলভিং এর উপর ফোকাস করে, ধীরে ধীরে শিশুদের বড় করে তোলা হয়। আর আমাদের দেশে শিশুদের মুখস্ত বিদ্যার মূলমন্ত্রে গড়ে তোলা হচ্ছে। জার্মানীতে শিশুদের স্কুলের প্রথম দিনে, ‘স্কুলকোণ’ নামক বিশেষ উপহার তুলে দেওয়া হয়। যেখানে থাকে স্কুল সামগ্রী, ফুল, খেলনা এবং মিস্টান্ন। সেখানে বাংলাদেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের হাতে ধরিয়ে দেওয়া হয়, বিশাল বইয়ের তালিকা। শিক্ষার্থীদের চেয়ে বইয়ের ব্যাগের ওজনই বেশি। চাইনিজ স্কুলে বিরতি দেওয়া হয় এক ঘন্টা, স্কুলেই শিক্ষার্থীদের ঘুমানোরও ব্যবস্থা রয়েছে। বাংলাদেশে ওই সময় প্রাইভেট, কোচিং, স্যারের বাসায় দৌঁড়াদৌঁড়িতে ব্যস্ত থাকে কোমলমতি শিক্ষার্থীরা। ম্যাক্সিকোতে স্কুলের সময় নির্ধারণ করা হয় পরিবারের সাথে লাঞ্চ করার সুযোগ রেখে। অথচ বাংলাদেশের শিক্ষার্থীদের বাইরে যেতে দেওয়া হয় না স্কুল পালানোর ভয়ে। বেলজিয়ামে দশ বছর পর্যন্ত হোমওয়ার্ক দেওয়ার সিস্টেম নেই। অথচ বাংলাদেশের শিক্ষার্থীরা দিবা-রাত্রি, সকাল-বিকাল, আরাম আয়েশ, খেলাধুলা, ঘুম হারাম করে শিক্ষা নামের প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ হচ্ছে। সিঙ্গাপুরের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে একাডেমিক শিক্ষার চাপ লাঘবে সহপাঠ কার্যক্রমকে অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়ে কার্যকর করা হয়। ওই দেশ বিশ্বের অন্যতম শিক্ষা ব্যবস্থার তালিকাভূক্ত। অথচ বাংলাদেশে খন্ড খন্ড প্রাইভেট, কোচিং , প্রাতিষ্ঠানিক বিশেষ ক্লাস। বিভিন্ন অজুহাতে তালাবদ্ধ সহপাঠ কার্যক্রমের সকল দরজা। এ যেন নিরানন্দ, যন্ত্রনাময় নরককুন্ডে নিমজ্জিত শিক্ষা জীবন। অর্থাৎ মনসুর আলী সম্ভবত ; শিক্ষা ব্যবস্থার সার্বিক উন্নয়নে শিশুদের ঘিরে রাষ্ট্রপতির স্বপ্ন বাস্তবায়নে, ড. জাফর ইকবালের অভিভাবক নামের ‘প্রজাতি’ দূরীকরণে উন্নত বিশ্বের কোন মডেল আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থায় কার্যকর করা যায় কিনা ? এমনটাই হয়তোবা বলতে চেয়েছে। এক্ষেত্রে হাজারো শিক্ষা গবেষক, শিক্ষাকর্মী ও শিক্ষাদরদী জ্ঞান পিপাসুরা এমনটি কামনা করছে। তবে আমার একটিই আবেদন, মাননীয় শিক্ষামন্ত্রী আমার মাদ্রাসার ওই ছাত্রের মত লক্ষ কোটি ছাত্রের গাইড বই কি নিষিদ্ধ হবে ? নাকি তার এলাকার জনমানুষের কথামত আমার সরকারের বদনাম ঠেকাতে আমি না হয় একটা গাইড বই কিনেই দিলাম ? বাকিদের অবস্থাটা…………..!

লেখক, শিক্ষক, সাংবাদিক ও কলামিস্ট